লালু
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
তার ডাকনাম ছিল লালু। ভালো নাম অবশ্য একটা ছিলই, কিন্তু মনে নেই। জানো বোধ হয়, হিন্দিতে ‘লাল’ শব্দটার অর্থ হচ্ছে প্রিয়। এ-নাম কে তারে দিয়েছিল জানিনে, কিন্তু মানুষের সঙ্গে নামের এমন সঙ্গতি কদাচিৎ মেলে। সে ছিল সকলের প্রিয়।
ইস্কুল ছেড়ে আমরা গিয়ে কলেজে
ভর্তি হলাম, লালু বললে, সে
ব্যবসা করবে। মায়ের কাছে দশ টাকা
চেয়ে নিয়ে সে ঠিকেদারি শুরু
করে দিলে। আমরা বললাম, লালু তোমার পুঁজি তো দশ টাকা। সে
হেসে
বললে, আর কত চাই, এই তো
ঢের। সবাই তাকে ভালোবাসত, তার কাজ জুটে গেল। তার পরে কলেজের পথে প্রায়ই দেখতে
পেতাম, লালু ছাতি মাথায় জনকয়েক কুলি-মজুর নিয়ে রাস্তার ছোটখাটো মেরামতের কাজে লেগেছে।
আমাদের দেখে হেসে তামাশা করে বলত- যা যা দৌড়ো পারসেন্টেজের খাতায় এখুনি ঢ্যারা পড়ে যাবে।
আরও ছোটকালে যখন আমরা বাংলা
ইস্কুলে পড়তাম, তখন সে ছিল
সকলের মিস্ত্রি। তার বইয়ের থলির মধ্যে সর্বদাই
মজুত থাকত একটা হামানদিস্তার ডাঁটি, একটা
নরুণ, একটা ভাঙা ছুরি, ফুটো
করবার একটা পুরোনো তুরপুনের ফলা, একটা ঘোড়ার নাল।
(৯)
কী জানি কোথা থেকে সে এসব সংগ্রহ করেছিল, কিন্তু এ দিয়ে করতে পারত না
সে এমন কাজ নেই। ইস্কুল-সুদ্ধ সকলের ভাঙা ছাতি সারানো, শ্লেটের ফ্রেম আঁটা, খেলতে গিয়ে ছিঁড়ে গেলে তখনি
জামা-কাপড়
সেলাই করে দেওয়া এমন কত কি।
কোনো কাজে কখনো না বলত না।
আর করতও চমৎকার। একবার ‘ছট’ পরবের দিনে কয়েক পয়সার রঙিন কাগজ আর শোলা কিনে কি একটা নতুন তৈরি করে সে গঙ্গার ঘাটে বসে প্রায় আড়াই টাকার খেলনা বিক্রি করে ফেললে। তার থেকে আমাদের পেটভরে চিনেবাদাম ভাজা খাইয়ে দিলে।
আর করতও চমৎকার। একবার ‘ছট’ পরবের দিনে কয়েক পয়সার রঙিন কাগজ আর শোলা কিনে কি একটা নতুন তৈরি করে সে গঙ্গার ঘাটে বসে প্রায় আড়াই টাকার খেলনা বিক্রি করে ফেললে। তার থেকে আমাদের পেটভরে চিনেবাদাম ভাজা খাইয়ে দিলে।
বছরের পর বছর যায়, সকলে বড় হয়ে উঠলাম। জিমনাস্টিকের আখড়ায় লালুর সমকক্ষ
কেউ ছিল না। তার গায়ে জোর ছিল যেমন অসাধারণ, সাহস ছিল তেমনি অপরিসীম। ভয় কারে কয় সে বোধ করি জানত না। সকলের ডাকেই সে
প্রস্ত্তত, সবার বিপদেই সে সকলের আগে এসে উপস্থিত। কেবল তার একটা মারাত্মক দোষ ছিল, কাউকে ভয় দেখাবার সুযোগ পেলে সে কিছুতে নিজেকে
সামলাতে পারত না। এতে ছেলে বুড়ো গুরুজন সবাই তার কাছে সমান। আমরা
কেউ ভেবে পেতাম না, ভয় দেখাবার
এমন সব অদ্ভুত ফন্দি তার
মাথায় এক নিমিষেই কোথা থেকে আসে! দু-একটা ঘটনা বলি।
পাড়ার মনোহর চাটুজ্জের বাড়ি কালীপূজো। দুপুর-রাতে বলির ক্ষণ বয়ে যায়, কিন্তু কামার অনুপস্থিত। লোক ছুটল ধরে
আনতে, কিন্তু গিয়ে দেখে সে পেটের ব্যথায় অচেতন। ফিরে এসে সংবাদ দিতে সবাই মাথায় হাত
দিয়ে বসল, উপায়! এত রাতে ঘাতক মিলবে কোথায়? দেবীর
পূজো পন্ড হয়ে যায় যে! কে একজন বললে, পাঁঠা
কাটতে পারে লালু। এমন অনেক সে কেটেছে। লোক দৌড়ল তার কাছে। লালু ঘুম
ভেঙে উঠে বসল, বলল- না।
না কী গো? দেবীর পূজোয় ব্যাঘাত ঘটলে সর্বনাশ হবে যে!
লালু বললে, হয় হোক গে। ছোটবেলায় ও-কাজ করেছি, কিন্তু
এখন আর করব না।
যারা ডাকতে এসেছিল তারা মাথা কুটতে লাগল, আর দশ-পনেরো মিনিট মাত্র সময়, তার
পরে সব নষ্ট, সব শেষ। তখন মহাকালীর কোপে কেউ বাঁচবে না। লালুর বাবা এসে
আদেশ দিলেন যেতে। বললেন, ওঁরা নিরূপায় হয়েই এসেছেন,-না গেলে অন্যায় হবে। তুমি
যাও।
সে আদেশ অমান্য করার সাধ্য লালুর নেই।
লালুকে দেখে চাটুজ্জে মশায়ের
ভাবনা ঘুচল। সময় নেই,
তাড়াতাড়ি পাঁঠা উৎসর্গিত
হয়ে কপালে সিঁদুর, গলায় জবার মালা পরে হাড়িকাঠে
পড়ল, বাড়িসুদ্ধ সকলের ‘মা’ ‘মা’ রবের প্রচন্ড চিৎকারে নিরূপায় নিরীহ জীবের শেষ
আর্তকণ্ঠ কোথায় ডুবে গেল, লালুর হাতে খাঁড়া নিমিষে ঊর্ধ্বোত্থিত হয়েই সজোরে
নামল, তার পরে বলির ছিন্নকণ্ঠ থেকে রক্তের ফোয়ারা কালো মাটি রাঙা করে দিলে। লালু
ক্ষণকাল চোখ বুজে রইল। ক্রমশ ঢাক ঢোল কাঁসির সংমিশ্রণে বলির বিরাট বাজনা থেমে এল।
যে পাঁঠাটা অদূরে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল আবার তার কপালে চড়ল সিঁদুর, গলায় দুললো রাঙা মালা, আবার
সেই হাড়িকাঠ, সেই ভয়ঙ্কর অন্তিম আবেদন,সেই বহুকণ্ঠের সম্মিলিত ‘মা’ ‘মা’ ধ্বনি।
(১০)
ঢুলিরা উন্মাদের মতো ঢোল বাজাচেছ। উঠানে ভিড় করে দাঁড়িয়ে
বহু লোকের বহু প্রকারের কোলাহল;
সম্মুখের বারান্দায়
কার্পেটের আসনে বসে মনোহর চাটুজ্জে মুদ্রিত নেত্রে ইষ্টনাম জপে রত, অকস্মাৎ লালু ভয়ঙ্কর একটা হুঙ্কার
দিয়ে উঠল। সাড়া-শব্দ গেল থেমে-সবাই বিস্ময়ে স্তব্ধ-এ আর কী! লালুর
অসম্ভব বিস্ফোরিত চোখের
তারা দুটো যেন ঘুরছে, চেঁচিয়ে বললে, আর
পাঁঠা কই?
বাড়ির কে একজন ভয়ে ভয়ে জবাব
দিলে, আর ত পাঁঠা নেই। আমাদের শুধু দুটো করেই বলি হয়।
লালু তার হাতের রক্তমাখা খাঁড়াটা মাথার উপরে বার-দুই ঘুরিয়ে ভীষণ
কর্কশকণ্ঠে গর্জন করে উঠল-
নেই পাঁঠা? সে হবে না। আমার খুন চেপে
গেছে- দাও পাঁঠা, নইলে
আজ আমি যাকে পাব ধরে নরবলি
দেব- ‘মা’ ‘মা’-জয়-কালী! বলেই একটা মস্ত লাফ দিয়ে সে হাড়িকাঠের
এদিক থেকে ওদিক গিয়ে পড়ল। তার হাতের খাঁড়া তখন বনবন করে ঘুরচে। তখন যে কান্ড ঘটল ভাষায় বর্ণনা করা
যায় না।
সবাই একসঙ্গে ছুটল সদর
দরজার দিকে, পাছে লালু ধরে ফেলে। পালাবার চেষ্টায় বিষম ঠেলাঠেলি।
হুড়োমুড়িতে সেখানে যেন দক্ষযজ্ঞ ব্যাপার বেধে গেল। কেউ
পড়েছে গড়িয়ে, কেউ হামাগুড়ি দিয়ে, কারও পায়ের ফাঁকের মধ্যে মাথা গলিয়ে বেরোবার চেষ্টা
করছে, কারও গলা কারও বগলের চাপের মধ্যে পড়ে দম আটকাবার মতো হয়েছে, একজন আর একজনের ঘাড়ের উপর
দিয়ে পালাবার চেষ্টায় ভিড়ের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়েছে- কিন্তু এসব মাত্র মুহূর্তের জন্য। তার পরেই সমস্ত
ফাঁকা।
লালু গর্জে উঠল- মনোহর চাটুজ্জে কই? পুরুত গেল কোথায়?
পুরুত রোগা লোক, সে গন্ডগোলের সুযোগে আগেই গিয়ে
লুকিয়েছে প্রতিমার আড়ালে। গুরুদেব কুশাসনে বসে চন্ডীপাঠ করছিলেন, তাড়াতাড়ি উঠে ঠাকুর দালানের একটা মোটা থামের পিছনে
গা-ঢাকা
দিয়েছেন। কিন্তু, বিপুলায়তন দেহ নিয়ে মনোহরের
পক্ষে ছুটাছুটি করা কঠিন। লালু এগিয়ে গিয়ে বাঁ হাতে তাঁর একটা হাত চেপে ধরলে, বললে, চলো হাড়িকাঠে গিয়ে গলা দেবে।
একে তার বজ্রমুষ্টি, তাতে ডান হাতে খাঁড়া, ভয়ে চাটুজ্জের প্রাণ উড়ে গেল। কাঁদো-কাঁদো গলায়
মিনতি করতে লাগলেন, লালু! বাবা! স্থির
হয়ে চেয়ে দেখ- আমি পাঁঠা নই, মানুষ।
আমি সম্পর্কে তোমার জ্যাঠামশাই হই বাবা, তোমার বাবা আমার ছোটভাইয়ের মতো।
সে জানিনে। আমার খুন চেপেছে- চলো তোমাকে বলি দেব! মায়ের আদেশ!
চাটুজ্জে ডুকরে কেঁদে উঠলেন- না বাবা, মায়ের
আদেশ নয়, কখ্খনো নয়-মা যে জগজ্জননী।
লালু বললে-জগজ্জননী ! সে জ্ঞান আছে তোমার? আর
দেবে পাঁঠা-বলি? ডেকে
পাঠাবে আমাকে পাঁঠা কাটতে? বলো।
(১১)
চাটুজ্জে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, কোনোদিন নয় বাবা, আর কোনোদিন নয়, মায়ের
সমুখে তিন সত্যি করছি, আজ থেকে আমার বাড়িতে বলি বন্ধ।
ঠিক তো?
ঠিক বাবা ঠিক। আর কখনো না। আমার হাতটা ছেড়ে দাও বাবা, একবার পায়খানায় যাব।
লালু হাত ছেড়ে দিয়ে বললে- আচ্ছা যাও, তোমাকে ছেড়ে দিলাম। কিন্তু পুরুত পালাল কোথা দিয়ে?
গুরুদেব? সে কই? এই বলে সে পুনশ্চ একটা হুঙ্কার দিয়ে লাফ মেরে ঠাকুর
দালানের দিকে অগ্রসর হতেই প্রতিমার পিছন ও থামের আড়াল হতে দুই বিভিন গলার
ভয়ার্ত ক্রন্দন উঠল। সরু ও মোটায় মিলিয়ে সে শব্দ এমন অদ্ভুত ও হাস্যকর যে, লালু নিজেকে আর সামলাতে পারলে না। হাঃ হাঃ হাঃ করে হেসে উঠে দুম করে
মাটিতে খাঁড়াটা ফেলে দিয়ে এক দৌড়ে বাড়ি ছেড়ে পালাল।
তখন কারও বুঝতে বাকি রইল না
খুনচাপা-টাপা সব মিথ্যে, সব তার চালাকি। লালু শয়তানি
করে এতক্ষণ সবাইকে ভয় দেখাচ্ছিল। মিনিট-পাঁচেকের মধ্যে যে
যেখানে পালিয়েছিল ফিরে এসে জুটল। ঠাকুরের পূজো তখনো বাকি, তাতে যথেষ্ট বিঘ্ন ঘটেছে এবং মহা হৈচৈ কলরবের মধ্যে
চাটুজ্জে মশাই সকলের সম্মুখে বারবার প্রতিজ্ঞা করতে লাগলেন- ঐ বজ্জাত ছোঁড়াটাকে যদি না
কাল সকালেই ওর বাপকে দিয়ে পঞ্চাশ ঘা জুতো খাওয়াই ত আমার নামই মনোহর
চাটুজ্জে নয়।
কিন্তু জুতো তাকে খেতে হয়নি।
ভোরে উঠেই সে যে কোথায় পালাল, সাত-আটদিন কেউ তার খোঁজ পেল না। দিন-সাতেক পরে
একদিন অন্ধকারে লুকিয়ে মনোহর চাটুজ্জের বাড়িতে ঢুকে তাঁর ক্ষমা এবং পায়ের ধুলো নিয়ে সে-যাত্রা বাপের ক্রোধ থেকে নিস্তার পেলে। কিন্তু সে যাই হোক, দেবতার সামনে সত্য করেছিলেন বলে চাটুজ্জে
বাড়ির কালীপূজোয় তখন থেকে পাঁঠাবলি উঠে গেল।
No comments:
Post a Comment