আদুভাই
আবুল মনসুর আহমদ
এক
আদুভাই ক্লাস সেভেনে পড়তেন। ঠিক পড়তেন না বলে পড়ে থাকতেন
বলাই ভালো। কারণ ঐ বিশেষ শ্রেণি ব্যতীত আর কোনো শ্রেণিতে তিনি কখনো পড়েছেন কিনা, পড়ে থাকলে ঠিক কবে পড়েছেন, সে - কথা ছাত্ররা কেউ জানত না। শিক্ষকরাও অনেকে জানতেন না বলেই
বোধ হতো।
শিক্ষকরাও অনেকে তাঁকে ‘আদুভাই’ বলে
ডাকতেন। কারণ নাকি এই যে, তাঁরাও এককালে আদুভাইয়ের সহপাঠী ছিলেন এবং সবাই নাকি ক্লাস - সেভেনেই আদুভাইয়ের সঙ্গে
পড়েছেন।
আমি যখন ক্লাস সেভেনে আদুভাইয়ের সহপাঠী হলাম ততদিনে আদুভাই
ঐ শ্রেণির পুরাতন টেবিল ব্ল্যাকবোর্ডের মতোই নিতান্ত অবিচেছদ্য এবং অত্যন্ত স্বাভাবিক অঙ্গে পরিণত হয়ে
গিয়েছেন।
(৩৩)
আদুভাইয়ের এই অসাফল্যে আর যে - ই যত হতাশ হোক, আদুভাইকে
কেউ কখনো বিষণ্ন দেখেনি।
কিম্বা নম্বর বাড়িয়ে দেবার
জন্য তিনি কখনো কোনো শিক্ষক বা পরীক্ষককে অনুরোধ করেননি। যদি কখনো কোনো বন্ধু বলেছে: যান না আদুভাই, যে
কয় সাবজেক্টে শর্ট আছে, শিক্ষকদের বলে কয়ে নম্বরটা নিন না বাড়িয়ে। তখন
গম্ভীরভাবে আদুভাই জবাব দিয়েছেন, সব সাবজেক্টে পাকা হয়ে ওঠাই ভালো।
কোন কোন সাবজেক্টে শর্ট, সুতরাং পাকা হওয়ার প্রয়োজন আছে, তা কেউ জানতো না। আদুভাইও জানতেন না; জানবার কোনো চেষ্টাও করেননি; জানবার আগ্রহও যে তাঁর আছে, তাও
বোঝবার উপায় ছিল না। বরং তিনি যেন মনে করতেন, ওরকম আগ্রহ প্রকাশ করাই
অন্যায় ও অসঙ্গত। তিনি
বলতেন, যেদিন তিনি সব সাবজেক্টে পাকা হবেন, প্রমোশন সেদিন তাঁর কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। সে শুভ দিন যে একদিন আসবেই সে-বিষয়ে আদুভাইয়ের এতটুকু
সন্দেহ কেউ কখনো দেখেনি।
কত খারাপ ছাত্র প্রশ্নপত্র চুরি
করে অপরের খাতা নকল করে আদুভাইয়ের ঘাড়ের উপর দিয়ে প্রমোশন নিয়ে চলে গিয়েছে, এ - ধরনের
ইঙ্গিত আদুভাইয়ের কাছে কেউ করলে, তিনি গর্জে উঠে বলতেন,
জ্ঞানলাভের জন্যই আমরা
স্কুলে পড়ি, প্রমোশন লাভের জন্য পড়ি না।
সেজন্য অনেক সন্দেহবাদী বন্ধু
আদুভাইকে জিজ্ঞেস করেছে, আদুভাই, আপনার কী সত্যিই প্রমোশনের আশা আছে?
নিশ্চিত বিজয়গৌরবে আদুভাইয়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তিনি
তাচ্ছিল্যভরে বলেছেন, আজ হোক, কাল হোক, প্রমোশন আমাকে দিতেই হবে।
তবে হ্যাঁ, উন্নতি আস্তে আস্তে হওয়াই ভালো। যে গাছ লকলক করে বেড়েছে, সামান্য বাতাসেই তার ডগা ভেঙেছে।
সেজন্য আদুভাইকে কেউ কখনো
পিছনের বেঞ্চিতে বসতে দেখেনি। সামনের বেঞ্চিতে বসে তিনি শিক্ষকদের প্রত্যেকটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, হা করে গিলতেন, মাথা নাড়তেন ও প্রয়োজনমতো নোট করতেন।
খাতার সংখ্যা ও সাইজে আদুভাই ছিলেন ক্লাসের একজন অন্যতম ভালো ছাত্র।
শুধু ক্লাসের নয়, স্কুলের মধ্যে তিনি সবার আগে পৌঁছুতেন।
এ ব্যাপারে শিক্ষক কি ছাত্র- কেউ তাঁকে
কোনোদিন হারাতে পেরেছে বলে
শোনা যায়নি।
স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী সভায় আদুভাইকে আমরা বরাবর
দুটো পুরস্কার পেতে দেখেছি। আমরা শুনেছি, আদুভাই কোন অনাদিকাল থেকে ঐ দুটো পুরস্কার পেয়ে আসছেন। তার একটি, স্কুল কামাই না করার জন্য; অপরটি সচ্চরিত্রতার
জন্য। শহরতলির পাড়া - গাঁ থেকে রোজ রোজ পাঁচ মাইল রাস্তা তিনি হেঁটে আসতেন
বটে; কিন্তু ঝড়-তুফান, অসুখ-বিসুখ কিছুই তাঁর এ কাজের
অসুবিধে সৃষ্টি করে উঠতে পারেনি। চৈত্রের কালবৈশেখী বা শ্রাবণের
ঝড়ঝঞ্ঝায় যেদিন পশুপক্ষীও ঘর থেকে বেরোয়নি, সেদিনও ছাতার নিচে নুড়িমুড়ি হয়ে, বাতাসের
সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আদুভাইকে
স্কুলের পথে এগোতে দেখা
গিয়েছে। মাইনের মমতায় শিক্ষকরা অবশ্য স্কুলে আসতেন। তেমন দুর্যোগে ছাত্ররা কেউ আসেনি নিশ্চিত জেনেও নিয়ম
রক্ষার জন্য তাঁরা ক্লাসে একটি উঁকি মারতেন। কিন্তু তেমন দিনেও অন্ধকার কোণ থেকে ‘আদাব, স্যার’ বলে
যে-একটি ছাত্র শিক্ষকদের চমকিয়ে দিতেন তিনি ছিলেন আদুভাই।
আর চরিত্র? আদুভাইকে কেউ কখনো রাগ কিম্বা অভদ্রতা করতে কিম্বা মিছে কথা বলতে
দেখেনি।
(৩৪)
স্কুলে ভর্তি হবার পর প্রথম
পরীক্ষাতেই আমি ফার্স্ট হলাম। সুতরাং আইনত আমি ক্লাসের মধ্যে সবচাইতে ভালো ছাত্র এবং আদুভাই সবার চাইতে খারাপ
ছাত্র ছিলেন। কিন্তু কী জানি কেন, আমাদের
দুজনার মধ্যে একটা বন্ধন
সৃষ্টি হলো। আদুভাই প্রথম থেকেই আমাকে যেন নিতান্ত আপনার লোক বলে ধরে নিলেন। আমার ওপর যেন তাঁর কতকালের দাবি।
আদুভাই মনে করতেন, তিনি কবি ও বক্তা। স্কুলের
সাপ্তাহিক সভায় তিনি বক্তৃতা ও স্বরচিত কবিতা পাঠ করতেন। তাঁর কবিতা শুনে
সবাই হাসতো। সে হাসিতে আদুভাই লজ্জাবোধ করতেন না, নিরুৎসাহও হতেন না। বরঞ্চ
তাকে তিনি প্রশংসাসূচক হাসিই মনে করতেন। তাঁর উৎসাহ দ্বিগুণ বেড়ে যেত।
অন্যসব ব্যাপারে আদুভাইকে বুদ্ধিমান বলেই মনে হতো। কিন্তু
এই একটি ব্যাপারে তাঁর নির্বুদ্ধিতা দেখে আমি দুঃখিত হতাম। তাঁর নির্বুদ্ধিতা নিয়ে ছাত্র-শিক্ষক সবাই তামাশা করছেন, অথচ
তিনি তা বুঝতে পারছেন না, দেখে আমার মন আদুভাইয়ের পক্ষপাতী হয়ে উঠত।
গেল এইভাবে চার বছর। আমি ম্যাট্রিকের জন্য টেস্ট পরীক্ষা
দিলাম। আদুভাই কিন্তু সেবারও যথারীতি ক্লাস সেভেনেই অবস্থান করছিলেন।
দুই
ডিসেম্বর মাস।
সব ক্লাসের পরীক্ষা ও প্রমোশন হয়ে গিয়েছ। প্রথম বিবেচনা, দ্বিতীয় বিবেচনা, তৃতীয় বিবেচনা ও বিশেষ বিবেচনা ইত্যাদি সকল
প্রকারের বিবেচনা হয়ে গিয়েছে। বিবেচিত প্রমোশন-প্রাপ্তের সংখ্যা অন্যান্য বারের ন্যায়
সেবারও পাস-করা প্রমোশন-প্রাপ্তের সংখ্যার
দ্বিগুণেরও ঊর্ধ্বে উঠেছে।
কিন্তু আদুভাই এসব বিবেচনার বাইরে। কাজেই তাঁর কথা প্রায়
ভুলেই গিয়েছিলাম। টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে আমরা টিউটরিয়েল ক্লাস করছিলাম। ছাত্ররা শুধু শুধু স্কুলপ্রাঙ্গণে জটলা
করছিল-প্রমোশন পাওয়া ছেলেরা নিজেদের কীর্তি-উজ্জ্বল চেহারা দেখাবার জন্য, আর না-পাওয়া ছেলেরা প্রমোশনের
কোনো প্রকার অতিরিক্ত বিশেষ বিবেচনার দাবি জানাবার জন্য।
এমন দিনে একটু নিরালা জায়গায় পেয়ে হঠাৎ আদুভাই আমার পা
জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। আমি চমকে উঠলাম। আদুভাইকে আমরা সবাই মুরুবিব মানতাম। তাই তাঁকে ক্ষিপ্রহস্তে টেনে
তুলে প্রতিদানে
তাঁর পা ছুঁয়ে বললাম, কী হয়েছে আদুভাই, অমন পাগলামি করলেন কেন?
আদুভাই কম্পিত কণ্ঠে বললেন, প্রমোশন।
আমি বিস্মিত হলাম;
বললাম, প্রমোশন? প্রমোশন কী? আপনি
প্রমোশন পেয়েছেন?
: না, আমি
প্রমোশন পেতে চাই।
: ও, পেতে চান? সে তো সবাই চায়।
আদুভাই অপরাধীর ন্যায় উদ্বেগ-কম্পিত ও সংকোচ-জড়িত প্যাঁচ-মোচড় দিয়ে যা বললেন, তার
মর্ম এই যে, প্রমোশনের জন্য এতদিন তিনি কারও কাছে কিছু বলেননি ; কারণ, প্রমোশন জিনিসটাকে যথাসময়ের পূর্বে এগিয়ে
আনাটা তিনি পছন্দ করেন না। কিন্তু একটা বিশেষ কারণে এবার তাঁকে প্রমোশন পেতেই হবে।
(৩৫)
সে নির্জনতায়ও তিনি আমার কানের
কাছে মুখ এনে সেই কারণটি বললেন। তা এই যে, আদুভাইর ছেলে সেবার ক্লাস সেভেনে প্রমোশন পেয়েছে। নিজের ছেলের প্রতি আদুভাইয়ের কোনো ঈর্ষা নেই। কাজেই ছেলের সঙ্গে এক শ্রেণিতে পড়ার
তাঁর আপত্তি ছিল না। কিন্তু আদুভাইয়ের স্ত্রীর তাতে ঘোরতর আপত্তি আছে। ফলে, হয় আদুভাইকে এবার প্রমোশন পেতে হবে, নয়তো
পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হবে।
পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে আদুভাই বাঁচবেন কী নিয়ে?
আমি আদুভাইয়ের বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পারলাম। তাঁর অনুরোধে
আমি শিক্ষকদের কাছে সুপারিশ করতে যেতে রাজি হলাম।
প্রথমে ফারসি-শিক্ষকের কাছে যাওয়া স্থির করলাম। কারণ, তিনি একদা আমাকে মোট একশত নম্বরের মধ্যে একশত পাঁচ
নম্বর দিয়েছিলেন। বিস্মিত হেডমাস্টার তার কারণ জিজ্ঞেস করায় মৌলবি সাব বলেছিলেন, ‘ছেলে সমস্ত প্রশ্নের শুদ্ধ উত্তর দেওয়ায় সে পূর্ণ
নম্বর পেয়েছে। পূর্ণ নম্বর পাওয়ার পুরস্কার স্বরূপ আমি খুশি হয়ে তাকে পাঁচ নম্বর বখশিশ দিয়েছি।’ অনেক তর্ক করেও হেডমাস্টার মৌলবি সাবকে এই কাজের
অসঙ্গতি বুঝাতে পারেননি।
মৌলবি সাব আদুভাইয়ের নাম শুনে
জ্বলে উঠলেন। অমন বেতমিজ ও খোদার না-ফরমান বান্দা তিনি কখনো দেখেননি বলে আস্ফালন
করলেন এবং অবশেষে টিনের বাক্স থেকে অনেক খুঁজে আদুভাইয়ের খাতা বের করে আমার সামনে ফেলে দিয়ে বললেন, দেখ।
আমি দেখলাম, আদুভাই মোটে তিন নম্বর পেয়েছে। তবু হতাশ হলাম না। পাসের
নম্বর দেয়ার জন্য
তাঁকে চেপে ধরলাম।
বড় দেরি হয়ে গিয়েছে, নম্বর সাবমিট করে ফেলেছেন, বিবেচনার স্তর
পার হয়ে গিয়েছে ইত্যাদি সমস্ত যুক্তির আমি সস্তোষজনক জবাব দিলাম। তিনি বললেন, তুমি কার জন্য, কী
অন্যায় অনুরোধ করছ; খাতাটা খুলেই একবার দেখ না।
আমি মৌলবি সাবকে খুশি করবার জন্য অনিচছাসত্ত্বেও এবং
অনাবশ্যক বোধেও খাতাটা খুললাম। দেখলাম : ফারসি পরীক্ষা বটে, কিন্তু
খাতার কোথাও একটি ফারসি হরফ নেই। তার বদলে ঠাস-বুনানো বাংলা হরফে অনেক কিছু লেখা আছে। কৌতূহলবশে পড়ে
দেখলাম : এই বঙ্গদেশে ফারসি
ভাষা আমদানির অনাবশ্যকতা ও
ছেলেদের তা শিখবার চেষ্টার মূর্খতা সম্বন্ধে আদুভাই যুক্তিপূর্ণ একটি ‘থিসিস’ লিখে ফেলেছেন।
পড়া শেষ করে মৌলবি সাবের মুখের দিকে চাইতেই বিজয়ের ভঙ্গিতে
বললেন, দেখেছ বাবা বেতমিজের কাজ? আমি নিতান্ত ভালো মানুষ বলেই তিনটে নম্বর দিয়েছি, অন্য কেউ হলে রাসটিকেটের সুপারিশ করত।
যাহোক, শেষ পর্যন্ত মৌলবি সাব আমার অনুরোধ এড়াতে পারলেন না। খাতার
উপর ৩-এর পৃষ্ঠে ৩
বসিয়ে ৩৩ করে দিলেন।
আমি বিপুল আনন্দে অঙ্কের পরীক্ষকের বাড়ি ছুটলাম।
সেখানে আদুভাইয়ের খাতার উপর লাল পেন্সিলের একটি প্রকান্ড
ভূমন্ডল আঁকা রয়েছে। ব্যাপারের গুরুত্ব বুঝেও আমার উদ্দেশ্য বললাম। অঙ্কের মাস্টার তো হেসেই খুন। হাসতে-হাসতে তিনি আদুভাইয়ের খাতা বের করে
আমাকে অংশবিশেষ পড়ে শোনালেন।
(৩৬)
তাতে আদুভাই লিখেছেন যে, প্রশ্নকর্তা ভালো-ভালো অঙ্কের প্রশ্ন ফেলে কতকগুলো বাজে ও
অনাবশ্যক প্রশ্ন করেছেন। সেজন্য এবং প্রশ্নকর্তার ত্রুটি সংশোধনের উদ্দেশ্যে আদুভাই নিজেই কতিপয় উৎকৃষ্ট প্রশ্ন লিখে তার বিশুদ্ধ
উত্তর দিচ্ছে-এইরূপ ভূমিকা করে আদুভাই যে-সমস্ত অঙ্ক করেছেন, শিক্ষক মহাশয় প্রশ্নপত্র ও
খাতা মিলিয়ে আমাকে দেখালেন যে, প্রশ্নের সঙ্গে আদুভাইর উত্তরের সত্যিই
কোনো সংস্রব নেই।
প্রশ্নপত্রের সঙ্গে মিল থাক, আর না থাক ; খাতায়
লেখা অঙ্ক শুদ্ধ হলেই নম্বর পাওয়া উচিত বলে আমি শিক্ষকের সঙ্গে অনেক
ধস্তাধস্তি করলাম। শিক্ষক মশায়, যাহোক, প্রমাণ করে দিলেন যে, তাও
শুদ্ধ হয়নি।
সুতরাং পাসের নম্বর দিতে তিনি রাজি হলেন না। তবে তিনি আমাকে
এই আশ্বাস দিলেন যে, অন্য সব সাবজেক্টের শিক্ষকদের রাজি করাতে পারলে তিনি
আদুভাইয়ের প্রমোশনে সুপারিশ করতে প্রস্তুত আছেন।
নিতান্ত বিষণ্নমনে অন্যান্য পরীক্ষকদের নিকটে গেলাম।
সর্বত্র অবস্থা প্রায় একরূপ। ভূগোলের খাতায় তিনি লিখেছেন যে, পৃথিবী গোলাকার এবং সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে, এমন গাঁজাখুরি গল্প তিনি বিশ্বাস করেন না। ইতিহাসের খাতায় লিখেছেন যে, কোন রাজা কোন সম্রাটের
পুত্র এসব কথার কোনো প্রমাণ
নেই। ইংরেজির খাতায় তিনি
নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও লর্ড ক্লাইভের ছবি পাশাপাশি আঁকবার চেষ্টা করেছেন-অবশ্য কে যে সিরাজ, কে
যে ক্লাইভ, নিচে লেখা না থাকলে তা বোঝা যেতো না।
হতাশ হয়ে হোস্টেলে ফিরে এলাম। আদুভাই আগ্রহ - ব্যাকুল চোখে আমার পথপানে
চেয়ে অপেক্ষা করছিলেন।
আমি ফিরে এসে নিষ্ফলতার খবর দিতেই তাঁর মুখটি ফ্যাকাশে হয়ে
গেল।
তবে আমার কী হবে ভাই? বলে তিনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।
কিছু একটা করবার জন্য আমার প্রাণও ব্যাকুল হয়ে উঠলো। বললাম, তবে কী আদুভাই, আমি
হেডমাস্টারের কাছে যাব?
আদুভাই ক্ষণিক আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বললেন, তুমি আমার জন্য যা করেছ,
সেজন্য ধন্যবাদ।
হেডমাস্টারের কাছে তোমার গিয়ে কাজ নেই। সেখানে যেতে হয় আমিই যাব। হেডমাস্টারের কাছে জীবনে আমি কিছু চাইনি। এই
প্রার্থনা তিনি আমার ফেলতে পারবেন না।
বলেই তিনি হনহন করে বেরিয়ে গেলেন।
আমি একদৃষ্টে দ্রুতগমনশীল
আদুভাইয়ের দিকে চেয়ে রইলাম। তিনি দৃষ্টির আড়াল হলে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মন দিলাম।
তিন
সেদিন বড়দিনের ছুটি আরম্ভ।
শুধু হাজিরা লিখেই স্কুল ছুটি দেয়া হলো।
আমি বাইরে এসে দেখলাম : স্কুলের গেটের সামনে একটি পোস্তার উপর একটি উঁচু টুল
চেপে তার উপর দাঁড়িয়ে আদুভাই হাত-পা নেড়ে বক্তৃতা করছেন। ছাত্ররা ভিড় করে তাঁর
বক্তৃতা শুনছে এবং মাঝে
মাঝে করতালি দিচ্ছে।
আমি শ্রোতৃমন্ডলীর ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়লাম।
(৩৭)
আদুভাই বলছিলেন, হাঁ, প্রমোশন আমি মুখফুটে কখনো চাইনি। কিন্তু সেজন্যই কী
আমাকে প্রমোশন না- দেয়া এঁদের উচিত হয়েছে? মুখফুটে
না চেয়ে এতদিন আমি এঁদের আক্কেল পরীক্ষা করলাম। এঁদের মধ্যে দানাই বলে কোনো
জিনিস আছে কী না, আমি তা যাচাই করলাম। দেখলাম, বিবেচনা বলে কোনো জিনিস এঁদের মধ্যে নেই। এঁরা নির্মম, হৃদয়হীন। একটি মানুষ যে চোখ বুজে এঁদের বিবেচনার উপর নিজের জীবন
ছেড়ে দিয়ে বসে আছে, এঁদের প্রাণ বলে কোনো জিনিস থাকলে সেকথা কী এঁরা এতদিন ভুলে থাকতে
পারতেন?
আদুভাইয়ের চোখ ছলছল করে উঠলো। তিনি বাম হাতের পিঠ দিয়ে চোখ
মুছে আবার বলতে লাগলেন,
আমি এঁদের কাছে কী আর বিশেষ
চেয়েছিলাম? শুধুমাত্র একটি প্রমোশন। তা দিলে এঁদের কী এমন লোকসান হতো? মনে করবেন না, প্রমোশন না - দেয়ায়
আমি রেগে গেছি। রাগ আমি করিনি। আমি শুধু ভাবছি, যাঁদের বুদ্ধি-বিবেচনার উপর হাজার হাজার
ছেলের বাপ - মা ছেলেদের জীবনের ভার দিয়ে নিশ্চিত থাকেন, তাঁদের আক্কেল কত কম। তাঁদের প্রাণের পরিসর কত অল্প!
একটু দম নিয়ে আদুভাই আরম্ভ করলেন, আমি বহুকাল এই স্কুলে পড়ছি। একদিন এক পয়সা মাইনে কম দেইনি। বছর-বছর নতুন-নতুন পুস্তক ও খাতা কিনতে আপত্তি
করিনি। ভাবুন, আমার কতগুলো
টাকা গিয়েছে। আমি যদি
প্রমোশনের এতই অযোগ্য ছিলাম, তবে এই দীর্ঘদিনের মধ্যে একজন শিক্ষকও আমায় কেন বললেন না, ‘আদুমিঞা, তোমার প্রমোশনের কোনো চান্স নেই, তোমার মাইনেটা আমরা নেব না।’ মাইনে দেবার
সময় কেউ বারণ করলেন না, পুস্তক কেনবার সময় কেউ নিষেধ করলেন না। শুধু প্রমোশনের বেলাতেই তাঁদের যত
নিয়মকানুন এসে বাঁধল? আমি ক্লাস সেভেন পাস করতে পারলাম না বলে ক্লাস
এইটেও পাস করতে পারতাম না, এই কথা এঁদের কে বলেছে? অনেকে ম্যাট্টিক-আইএ- তে কোনোমতে পাস করে বিএ এমএ - তে ফার্স্টক্লাস পেয়েছে, দৃষ্টান্ত
আমি অনেক দেখাতে পারি। কোনো কুগ্রহের ফেরেই আমি ক্লাস
সেভেনে আটকে পড়েছি। একবার কোনোমতে এই ক্লাসটা ডিঙোতে পারলেই আমি ভালো করতে পারতাম, এটা বুঝা মাস্টারবাবুদের উচিত ছিল। আমাকে একবার
ক্লাস এইটে প্রমোশন দিয়ে আমার লাইফের একটা চান্স এঁরা দিলেন না!
আদুভাইয়ের কণ্ঠরোধ হয়ে এল।
তিনি খানিক থেমে ধুতির খুঁটে নাক-চোখ মুছে নিলেন। দেখলাম, শ্রোতাগণের অনেকের গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
গলা পরিষ্কার করে আদুভাই আবার শুরু করলেন, আমি কখনো এতসব কথা বলিনি, আজো বলতাম না। বললাম শুধু এইজন্য যে, আমার বড়ছেলে এবার ক্লাস
সেভেনে প্রমোশন পেয়েছে। সে - ও এই স্কুলেই পড়তো। এই স্কুলের
শিক্ষকদের বিবেচনায় আমার আস্থা নেই বলেই আমি গতবারই আমার ছেলেকে অন্য স্কুলে ট্রান্সফার করে দিয়েছিলাম।
যথাসময়ে এই সতর্কতা অবলম্বন না করলে, আজ
আমাকে কী অপমানের মুখে পড়তে
হতো, তা আপনারাই বিচার করুন।
আদুভাইয়ের শরীর কাঁটা দিয়ে
উঠলো। তিনি গলায় দৃঢ়তা এনে আবার বলতে শুরু করলেন, কিন্তু
আমি সত্যকে জয়যুক্ত করবই।
আমি একদিন ক্লাস এইটে ...
এই সময় স্কুলের দারোয়ান এসে
সভা ভেঙে দিল। আমি আদুভাইয়ের দৃষ্টি এড়িয়ে চুপেচুপে সরে পড়লাম।
তারপর যেমন হয়ে থাকে-সংসার-সাগরের প্রবল স্রোতে কে
কোথায় ভেসে গেলাম, কেউ জানলাম না।
(৩৮)
চার
আমি সেবার বিএ পরীক্ষা দেব। খুব মন দিয়ে পড়ছিলাম। হঠাৎ লাল
লেফাফার এক পত্র পেলাম। কারও বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র হবে মনে করে খুললাম। ঝরঝরে তকতকে সোনালি হরফে ছাপা পত্র।
পত্রলেখক
আদুভাই। তিনি লিখেছেন, তিনি সেবার ক্লাস সেভেন
থেকে ক্লাস এইটে প্রমোশন পেয়েছেন বলে
বন্ধুবান্ধবদের জন্য কিছু
ডালভাতের ব্যবস্থা করেছেন।
দেখলাম, তারিখ অনেক আগেই চলে গিয়েছে। বাড়ি ঘুরে এসেছে বলে পত্র
দেরিতে পেয়েছি। ছাপাচিঠির সঙ্গে হাতের লেখা একটি পত্র। আদুভাইর
পুত্র লিখেছে, বাবার খুব অসুখ, আপনাকে দেখবেন তাঁর শেষ সাধ।
পড়াশোনা ফেলে ছুটে গেলাম আদুভাইকে দেখতে। এই চারবছর তাঁর
কোনো খবর নিইনি বলে লজ্জা-
অনুতাপে ছোট হয়ে যাচ্ছিলাম।
ছেলে কেঁদে বললো, বাবা মারা গিয়েছেন। প্রমোশনের জন্য তিনি এবার দিনরাত
এমন পড়াশোনা শুরু করেছিলেন যে, শয্যা নিলেন তবু পড়া ছাড়লেন না। আমরা সবাই তাঁর জীবন
সম্বন্ধে ভয় পেলাম। পাড়াসুদ্ধ লোক গিয়ে হেডমাস্টারকে ধরায় তিনি স্বয়ং
এসে বাবাকে প্রমোশনের আশ্বাস দিলেন। বাবা অসুখ নিয়েই পালকি চড়ে স্কুলে গিয়ে শুয়ে-শুয়ে পরীক্ষা দিলেন। আগের
কথামতো তাকে প্রমোশন দেয়া হলো। তিনি তাঁর ‘প্রমোশন উৎসব’ উদ্যাপন
করবার জন্য আমাকে হুকুম দিলেন। কাকে-কাকে আমন্ত্রণ করতে হবে, তার লিস্টও তিনি নিজহাতে করে দিলেন। কিন্তু সেই
উৎসবে যাঁরা যোগ দিতে এলেন, তাঁরা সবাই তাঁর জানাজা পড়ে বাড়ি ফিরলেন।
আমি চোখের পানি মুছে কবরের কাছে যেতে চাইলাম।
ছেলে আমাকে গোরস্তানে নিয়ে
গেল। দেখলাম, আদুভাইয়ের কবরে খোদাই-করা মার্বেল পাথরের ট্যাবলেটে লেখা রয়েছে :
click here to read more
click here to read more
No comments:
Post a Comment